সুনামগঞ্জ , শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ , ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, ধাপে ধাপে এগোবে সরকার : উপদেষ্টা হাসান আরিফ সুনামগঞ্জ-৩ আসনে তালহা আলমকে প্রার্থী ঘোষণা শান্তিগঞ্জে বিএনপি’র কর্মীসভা ও প্রবাসীদের সংবর্ধনা দ্বিতীয় দিনেও মঞ্চ মাতালেন নাট্যকর্মীরা আমন ধানে হাসছে কৃষক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা তুমি যে চেয়ে আছ আকাশ ভরে দুই দিনের রিমান্ডে ব্যারিস্টার সুমন দিরাই আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভা ধর্মপাশা কৃষি ঋণ কমিটির সভা এসএসসি’র টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করায় ছাত্রীর আত্মহত্যা জাউয়াবাজারে কৃষক দলের কমিটি গঠন ছাতকে গৃহবধূর আত্মহত্যা জনগণ যাতে সকল ক্ষমতার মালিক হতে পারেন তেমন দেশ গড়তে চাই : প্রধান উপদেষ্টা ধোপাজান-চলতি নদী : পথ বদলে চলছে বালু-পাথর লুট জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত আ.লীগ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা : শুনানি শেষ, রায় যে কোনো দিন অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতা দেবে স্পেন পথনাটক উৎসব উদ্বোধন জামালগঞ্জ উপজেলা জমিয়তের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত
কমরেড শ্রীকান্ত দাশ স্মরণ

তুমি যে চেয়ে আছ আকাশ ভরে

  • আপলোড সময় : ২৩-১১-২০২৪ ১২:৪৯:৪৪ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২৩-১১-২০২৪ ১২:৪৯:৪৪ পূর্বাহ্ন
তুমি যে চেয়ে আছ আকাশ ভরে
দ্বীপা দাশ:: তুমি যে চেয়ে আছ আকাশ ভরে শিরোনামের পঙক্তিটি রবি ঠাকুরের গানের। রাগ: সাহানা। তাল: দাদরা। রচনাকাল তেরশো বিশ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের তেরো তারিখ। গানটির প্রকাশকাল চৈত্রমাস। চোখে পড়লেও আমার স্মৃতিতে পরশ বোলাচ্ছে ভাটির হাওরের এক প্রান্তিক গ্রামের বর্ষার শ্রাবণ মাসের। ষড়ঋতুর হিসেব মতে বর্ষাকালের শেষ মাস শ্রাবণ মাস। ঘরে ঘরে শ্রাবণী/মনষা দেবীর পূজার আমেজ। পূজা শেষে রাত্রিবেলা পদ্মপুরাণ পড়ার জন্য পাশের বাড়িতে ঘরের মহিলারা সবাই গিয়েছিলো। বয়সে ছোট হওয়াতে রাতের সময় আর পদ্মপুরাণ পড়তে না পারায়, বাবা আমাকে ওদের সাথে যেতে নিষেধ করছিলো। তখন আমি ঘরে বসে কাঁদছিলাম। ঐ সময়ে ভাইয়ার চোখে পড়ায় ভাইয়া নিজে আমাকে নিয়ে তাদের সঙ্গে বসিয়ে কিভাবে পদ্মপুরাণ পড়তে হয় শিখিয়েছিলেন। ভাইয়া পদ্মপুরাণ পড়তে অনেক সুন্দর সুন্দর দোহা শিখিয়ে দিতেন। শিখিয়ে দিতেন লয়, কায়দা, তালসহ অনেক দিশা। কথা বলছিলাম ভাইয়া কমরেড শ্রীকান্ত দাশকে নিয়ে। জন্ম ১৯২৪ সালের ৫ জুলাই সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার আঙ্গারুয়া গ্রামে। প্রয়াত ২০০৯ সালের ১৯ শে নভেম্বর। মাতা জ্ঞানদায়িনী ও পিতা যোগেন্দ্র কুমার দাশের একমাত্র সন্তান ছিলেন। শৈশবেই বিশ্ববরেণ্য নেতাজী সুভাষ বসু, ইন্দিরাগান্ধিসহ বহু রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জ্ঞানতাপসদের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। ভাইয়া সমাজতন্ত্রে একনিষ্ঠ সিপিবি’র নিভৃত মৌলিক মানুষ হলেও ঠাম্মা ছায়া রানীর নামে আনাতেন “একতা” পত্রিকা। তাছাড়াও সিলেট বা বাহিরে আসা যাওয়া করলে আনতেন দৈনিক পত্রিকা। ছোটকাকু যখন সিলেট থেকে বাড়ি আসতেন দেখতাম ভাইয়া আর ছোট কাকু সারা দিন-রাত রাজনীতি আর রাজনীতির কথা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। বাপ-পুতে খেলতেন দাবা খেলা। আর ঠাম্মা আমাদের আঙ্গুল দিয়ে দেখাতেন দেখ- “বাপ-পুতের কি ভাইয়াপ”(বন্ধুত্ব)। ভাইয়া প্রচুর বই পড়াশুনা করতেন। আমাদেরকে খেলায় মত্ত করে, অনেক সময় শীতের দিনে উঠানে পাটি (চাটি) বিছিয়ে আবার গরমের দিনে অনেক সময় গাছের নিছে বই-পত্রিকা এসব পড়তেন। পড়তে পড়তে ভাইয়া কিংবা খেলতে খেলতে আমরা যখন ক্ষুধার্ত হতাম তখন মা, মণি (পিসি মণিকে আমরা শুধু মণি বলি) ওদেরকে কিছু খানা-খাবারের কথা বললে ওরা দিয়ে যেতো এবং দিলেই ভাইয়া নিজে খেতেন এবং আমাদের খাইয়ে দিতেন। খেলার ছলে শেখাতেন বিভিন্ন ছড়া-কবিতা। একবার খেলতে গিয়ে ভাইয়া একটি ছড়াও শিখিয়েছিলেন। ছড়াটি হলো- “যে দিকেতে সূর্য্য ওঠে ইহাই পূর্বদিক পশ্চিমিতে অস্ত যায় জানি আমি ঠিক। উত্তরেতে শীতকালে শীতল বাতাস বয় দক্ষিণেতে বসন্তে বয় রে মলয়।” এই কবিতাটির কবির নাম কি যেমন জানিনা ঠিক কবিতাটি কি ভাইয়াই লিখেছেন তাও জানি না কিন্তু ভাইয়ার শেখানো উক্ত কবিতাটির প্রত্যেকটি লাইন আজও মনে রয়েছে। মনে আসছে আমার গান শেখার প্রথম হাতেখড়ি হয় আমার ভাইয়ার হাতে। ভাইয়াই আমাকে প্রথম সা-রে-গা-মা শিখিয়েছিলেন। কিন্তু ভাইয়ার কাছে গান শেখা আমি স¤পূর্ণ করতে পারিনি। সেদিন শ্রদ্ধাস্পদ লেখক তাজুল দাদু এসে ভাইয়াকে আরো পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে গেলেন। পারিবারিক ও একজন শিশুমনের অন্তরে জানার ও চিন্তার বাইরে সমাজ বিনির্মাণে ভাইয়ার সুচিন্ত মস্তিষ্কের প্রখরতা। দেখতে পেলাম ভাইয়ার হাতের স্বচ্ছ পরিষ্কার লেখা। দারুনভাবে শব্দ চয়নের ভঙ্গিমা। ভাইয়া ভালভাবে জানতেন মোটর সাইকেল, বাই সাইকেল চালানো। ছিলেন হোমিও চিকিৎসক, ইনকামটেক্স লেখক ও ভাল মানের টেইলার। শুনেছি ভাইয়া টেইলারিং শিখেছিলেন তখনকার রাজধানী কলকাতা থেকে। ভাইয়াকে, পাউডার, ক্রিম, সেন্ট এই ধরনের কসমেটিক ব্যবহার করতে কখনো দেখিনি। তবে হাতঘড়ি পরতে পছন্দ করতেন। এখনো ট্রাংক খুললে ভাইয়ার বিয়ের হাতঘড়ি আমরা দেখি। ভাইয়া ইস্ত্রি করা সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরতেন ও ব্যবহার করতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন রুমাল। আমি তো ছোট ছিলাম তাই ভাইয়ার সাথে কোন জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার তেমন কোন সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে একবার আমি দুর্গাপূজা দেখতে গিয়েছিলাম যা ছিল ভাইয়ার সাথে প্রথম ও শেষ দুর্গাপূজা (২০০৯)। দিনটি ছিলো দুর্গাপূজার নবমী দিন। ভাইয়া আমি আর আমার পিসতুতো (মণি) দু’বোনকে নিয়ে দুর্গাপূজা দেখার জন্য শাল্লা সদরে নিয়ে যান। দুর্গাপূজা দেখিয়ে আমাদেরকে ডুমরা মনির মেসোশ্বশুরের বাড়িতে রেখে কি একটা দরকারে আবার বাজারে যান। আমরা প্রায় সারাদিন সেখানে ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করি। আনুমানিক সন্ধ্যার আগ-সময় ভাইয়া আমাদেরকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য সেখানে যান। মণি’র মেসোশ্বশুর আমাদেরকে তাদের বাড়িতে থাকার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু ভাইয়া বলেন বাড়িতে কেউ নেই তাই আমাদের নিয়ে বাড়িতে ফিরতে হবে। তাই আমরা বাড়িতে যাওয়ার জন্য উনাদের বাড়ি থেকে রওয়ানা হই। কিন্তু আমরা যখন ভাইয়ার ভাবশিষ্য ও উদীচী প্রিয় প্রাণকৃষ্ণ কাকুর বাড়ির সামনে হাঁটা অবস্থায় দেখি ভাইয়ার শরীর খারাপের দিকে, ভাইয়া বলছেন (আমাদেরকে ভাইয়া সম্বোধন করে) আমি আর এখন হাঁটতে পারবোনা। একটু জিরিয়ে আবার হাঁটবো। কিছুক্ষণ পর হাঁটার বদলে ভাইয়ার শরীর আরো খারাপ হতে থাকে এমনকি, দেখছি সঠিকভাবে কথাও বলতে পারছেন না। সেখানে আমরা কাউকে তেমন চিনতাম না। তাই ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করি। তখন প্রাণকৃষ্ণ কাকু আমাদের কাঁদতে নিষেধ করেন। ভাইয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় শাল্লা সদর হাসপাতালে। সেখানকার ডাক্তার জানান এখানে চিকিৎসা হবে না, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ভাইয়াকে সিলেটে নিয়ে যেতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল থেকে প্রাণকৃষ্ণ কাকু আরো কয়েকজনকে সাথে নিয়ে একটি ট্রলার রিজার্ভ করে সিলেটের দিকে রওয়ানা হন। এবং রাস্তায় আমাদেরকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যান। মণি (পিসি) ও ঠাম্মা একই ট্রলারে ভাইয়ার সাথে সিলেটে যান। এর মাস-কয়েকদিন পর ভাইয়া আমাদেরকে চিরদিনের মতো ছেড়ে চলে যান। ভাইয়ার মৃত্যুর সময় আমি এতোটাই ছোট ছিলাম যে ভাইয়ার মৃত্যু খবর শুনে মণি যেভাবে কাঁদছিলেন আমি মণিকে অনুসরণ করে ঠিক সেভাবেই কাঁদছিলাম। ভাইয়া কী ধরনের মানুষ ছিলেন তখন বুঝিনি। ছোটবেলা থেকে আমি আমাদের বাড়িতে ভাইয়ার শুয়ে থাকার পালংয়ের (চৌকি) এক পার্শে বিশ্বের বিখ্যাত কয়েকজন মনীষীদের ছবি দেখে আসছি। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ব মানবতার সাম্যের অন্যতম ও সমাজতন্ত্রের চিন্তক ফ্র্যাডরিক এঙ্গেলস, কার্ল মার্কস, বিশ্ব শ্রমিক শ্রেণির মহান নেতা ও রুশ বলশেভিক বিপ্লবের মহানায়ক ভøাদিমির ইলিচ উলিয়ানড লেনিন। দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছে কমরেড মণি সিং, উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্তদের মতো সমাজহিতৈষী মহামানবদের ছবি। সত্যি বলতে কি ভাইয়ার প্রতিটা বিষয়ে ইতিহাসের গন্ধ পাই। দেশ, মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, রাজনীতি ভাইয়ার জীবনের প্রতিটা বাঁকে ইতিহাসের রন্ধ্রে। ভাইয়া এমন এক ব্যক্তি যিনি অজো পাড়াগাঁয়ের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হয়েও দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমি আমার বাবার কাছ থেকে শুনেছি ভাইয়া একবার রিকসা করে সিলেটের কোন এক জায়গায় যাচ্ছিলেন। সেদিন ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারি। হঠাৎ তিনি রাস্তার মধ্যে দেখলেন একদল শিশুরা প্রভাতফেরীর র‌্যালি করে যাচ্ছে। এই র‌্যালি দেখা মাত্র তিনি রিকসা থেকে নেমে পড়লেন এবং নিজের জুতা বগলে নিয়ে তিনিও শিশুদের সাথে প্রভাতফেরীতে যোগদিলেন। এ থেকে বুঝা যায় তিনি নিজের দেশকে ও ভাষাকে কতোটুকু ভালবাসতেন। তিনি মানুষকে এতোটাই ভালবাসতেন যে নিজের দেহ মানুষের কল্যাণের জন্য দান করে যান। যা সাধারণ সমাজ ব্যবস্থায় এখনো কল্পনীয়। ভাইয়ার একটি শোকসভায় উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল সিলেট সিটি কর্পোরেশন হলরুমের ২৩/০১/২০১০ সালে। সেখানে রাজনীতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের আলোচনা এবং শিশুচোখে দেখা বাড়িতে জ্ঞানতাপসদের আনাগোনা পদার্পণে, সত্যি আজ এসে বুঝতে পারলাম ভাইয়া ছিলেন এক অনন্য চরিত্রের অধিকারী। আজ সমাজকর্মের মতো পঠিত বিষয়ে যখন বিদ্যাপীঠের এক বিল্ডিং হতে আরেক বিল্ডিংয়ে যাই, খেতে বসে যখন হোস্টেলে প্রতিদিনের সংবাদপত্র হাতে নেই, পড়তে বসে যখন বইয়ের পাতা উল্টাই কিংবা হোস্টেলের বারান্দা হতে গভীর চন্দ্রিমার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারটি চোখে পড়ে তখন প্রতিটা পরতে পরতে বুঝি উঁকি দেয় ভাইয়াকে নিয়ে রবি ঠাকুরের গানের পংক্তিদ্বয় “তুমি যে চেয়ে আছ আকাশ ভ’রে, নিশিদিন অনিমেষে দেখছ মোরে ॥” [দ্বীপা দাশ : স্নাতক ২য় বর্ষ (সম্মান), সমাজকর্ম বিভাগ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর এবং কমরেড শ্রীকান্ত দাশের জ্যেষ্ঠপুত্রের প্রথম তনয়া]

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স